
সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে নিহত ২৪
বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় তাণ্ডব চালিয়ে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ বিদায় নেয়ার পর বিভিন্ন জায়গায় আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে ক্ষতচিহ্ন। বাড়িঘর, গাছপালা, রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত হয়েছে, মাছের ঘেরসহ ফসলের জমি তলিয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে গাছপালা পড়ে ২৪ জন নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে চট্টগ্রামে শিশুসহ ৯ জন, লৌহজংয়ে মা-মেয়ে ও নাঙ্গলকোটে ঘুমন্ত অবস্থায় একই পরিবারের তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে কয়েকশ’ মানুষ। আশ্রয়শিবির ছেড়ে বাড়িতে ফিরে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন অনেক মানুষ। উপকূলীয় অধিকাংশ জেলায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধকারে রয়েছেন সেসব এলাকার মানুষ। মোবাইল ফোন চার্জ করতে না পারায় স্বজনের খোঁজখবর পর্যন্ত নিতে পারেননি অনেকে। আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো তথ্যে প্রতিবেদন।
চট্টগ্রাম , ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তাণ্ডব ও প্রবল জলোচ্ছ্বাসে চট্টগ্রামে শিশুসহ ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২০ জন। জলোচ্ছ্বাসে দেশের অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জের গুদাম, আড়তে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে তলিয়ে গেছে ফল-ফসলের মাঠ। বিধ্বস্ত হয়েছে কাঁচা-আধা পাকা বসতঘর। সিত্রাংয়ের তাণ্ডব চলাকালে মীরসরাই বঙ্গবন্ধু শিল্পাঞ্চল এলাকায় একটি ড্রেজার ডুবে আট শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা ডুবে যাওয়া ড্রেজার থেকে লাশ উদ্ধারে অভিযান শুরু করেছে। প্রবল জোয়ারে সীতাকুণ্ডের একটি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে চার মাস বয়সী এক শিশুর লাশ ভেসে এসেছে। ঘূর্ণিঝড় কেটে যাওয়ার পর গতকাল সকাল থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পুরোদমে চালু হয়েছে। জেটি থেকে বহির্নোঙরে সরিয়ে নেয়া ১৭টি জাহাজ ফের জেটিতে ভেড়ানো হয়েছে। গভীর সাগরে চলে যাওয়া ৭০টি মাদার ভেসেল বহির্নোঙরে ফিরে এসেছে। সেখান থেকে লাইটারেজ জাহাজে পণ্য খালাস শুরু হয়েছে। সচল হয়েছে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও।
গত সোমবার রাত থেকে শুরু হওয়া ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের তীব্রতা কম হলেও প্রবল জলোচ্ছ্বাসে বন্দরনগরীর বিশাল এলাকা ছাড়াও উপকূলীয় অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। প্রবল স্রোতের তোড়ে ফাটল ধরেছে পতেঙ্গার শহররক্ষা বাঁধ তথা সৈকত সড়কে। সড়ক উপচে জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় পতেঙ্গা, হালিশহর, ইপিজেড, আগ্রাবাদ, চাক্তাই, খাতুনগগঞ্জ, আছদগঞ্জ, বাকলিয়া, চাঁন্দগাওসহ বিস্তীর্ণ এলাকা। জলোচ্ছ্বাসে চাক্তাই, খাতুনগঞ্জে গুদাম, আড়তে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। হালিশহর পতেঙ্গা এলাকায় শিল্প কারখানা, দোকানপাট ও গুদাম, আড়ত প্লাবিত হওয়ায় ব্যাপক ক্ষতি হয়।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় ও প্রবল জোয়ারে উপকূলীয় ৬৬টি ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ৯৪টি বসতবাড়ি সম্পূর্ণ এবং পাঁচ হাজার ৭৬০টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৮ হাজার বাসিন্দা।
ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে মীরসরাই উপকূলের সন্দ্বীপ চ্যানেলে বালু তোলার ড্রেজার ডুবে আট শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। গত সোমবার রাত ১০টায় উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের ৩ নম্বর জেটি এলাকার পশ্চিমে এ ড্রেজার ডুবির ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- পটুয়াখালীর চরজৈনকাটি এলাকার বাসিন্দা আনিস মোল্লার দুই ছেলে শাহীন মোল্লা ও ইমাম মোল্লা, একই এলাকার ইউসুফ আলী হাওলাদারের পুত্র বশর হাওলাদার, মৃত লোকমান ফকিরের পুত্র জাহিদুল কবির, সেকান্দার হাওলাদারের পুত্র আল-আমিন হাওলাদার, নুরু সর্দারের পুত্র আলম সর্দার, আবদুল হক মোল্লার পুত্র মাহমুদ মোল্লা ও রহমান খানের পুত্র তারেক মোল্লা।
ড্রেজারটি থেকে বেঁচে ফেরা শ্রমিক মো. সালাম জানান, জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে সৈকত-২ নামে তাদের ড্রেজারটি ডুবে যায়। এর মালিক সৈকত এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে নিয়োগ দিয়েছে বেপজা। ড্রেজারটিতে থাকা ৯ শ্রমিকের মধ্যে তিনি কিনারে আসতে পারলেও বাকি ৮ শ্রমিক আটকা পড়েন।
ঘূর্ণিঝড়ের পর গতকাল সকালে কদমরসুল এলাকার আচোয়া শিপ ইয়ার্ড থেকে চার মাস বয়সী এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে এ ছেলে শিশুটি কোনো এলাকা থেকে ভেসে আসে। জলোচ্ছ্বাসে ভেসে আসা অর্ধ শতাধিক মহিষ উদ্ধার করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
স্টাফ রিপোর্টার, কুমিল্লা থেকে জানান, কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের হেসাখালের খামারপাড়া গ্রামে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ঘরের চালে বড় গাছ পরে ঘুমন্ত অবস্থায় একই পরিবারের তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হলেন, মালয়েশিয়া প্রবাসী নেজাম দিন, স্ত্রী শারমিন আক্তার সাথী ও কন্যা নুসরাত আক্তার লিজার।
You must log in to post a comment.