
এফডিসিতে পা দিয়েই এক দিনে তিন সিনেমা
‘প্রেমের কসম’ নামের একটি সিনেমা বানাবেন পরিচালক হাসিবুল ইসলাম। সেই সিনেমার জন্য তরুণ অভিনেতা নানা শাহকে পরিচালক নিয়ে গেলেন এফডিসিতে চুক্তি করতে। নিজে গাড়ি চালিয়ে এফডিসিতে গেলেন নানা শাহ। গাড়ি থেকে পা নামাতেই একজন পরিচালক ছুটে এলেন তাঁর কাছে। এসেই জানতে চাইলেন, আপনি কি অভিনয় করেন? নানা শাহ বললেন, ‘করব’। পরিচালক হাফিজ উদ্দীন জানালেন, ‘আমরা ‘বাজিগর’ নামের একটি সিনেমার জন্য ভিলেন খুঁজছি, আপনার মতো একজনকে দরকার।’ রাজী হয়ে গেলেন নানা শাহ। ‘প্রেমের কসম’ সিনেমার পর হেলাল খানের অফিসে গিয়ে ‘বাজিগর’ সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হলেন। একই দিনে ‘বাজিগর’ সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হওয়ার সময় ‘পৃথিবী আমাকে চায় না’ নামের আরেকটি সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হন। একদিনে তিন সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন নানা শাহ।
সবার আগে ‘বাজিগর’ সিনেমার শুটিং শুরু করেন নানা শাহ। একই দিনে দ্বিতীয় শিফটে শুরু হয়েছিল প্রথম চুক্তিবদ্ধ হওয়া ‘প্রেমের কসম’ সিনেমার শুটিং। এভাবেই খল চরিত্রের অভিনেতা হিসেবে ঢালিউডযাত্রা। তাঁর অভিনীত ‘বাজিগর’ ছিল প্রথম মুক্তি পাওয়া সিনেমা। এরপর যেন এলেন, দেখলেন, জয় করলেন।
‘বাজিগর’ সিনেমার মুক্তির পর খল চরিত্রে আলোচিত নাম হয়ে ওঠেন এই নানা শাহ। ভক্তদের কাছে নানা শাহ নামে পরিচিত হলেও তাঁর পারিবারিক নাম তারিক শাহ। নাম পরিবর্তনের ঘটনাটাও বেশ মজার। শুটিংয়ের সময় একদিন চিত্রগ্রাহক হঠাৎ কী মনে করে বললেন, ‘নানা শাহ, একটু ক্যামেরার দিকে সরে দাঁড়ান।’ পরে নামটা পরিচালকসহ সবাই শুনে বলতে লাগলেন নানা শাহ। দেখা গেল, সাংবাদিকেরা এলে পরিচালক পরিচয় করিয়ে দিতেন নানা শাহ বলে। এই অভিনেতা বলেন, ‘নিজের নামটা কীভাবে যেন হারিয়ে গেল। সংবাদমাধ্যমসহ সবার কাছে নানা শাহ হয়ে উঠলাম।’
পরে ‘অধিকার চাই, ‘তুমি আমার ভালোবাসা’, ‘আনন্দ অশ্রু’সহ একাধিক সিনেমায় খল চরিত্রে অভিনয় করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। হুমায়ূন ফরিদী, রাজীব, নাসির খানদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অভিনয় করতে থাকেন। জনপ্রিয়তা পেলেও একসময় তিনি অভিনয়ে পিছিয়ে পড়েন। নানা শাহ বলেন, ‘আমার দোষে আমি পিছিয়েছি। আমি অনেক রাগী, ইমোশনাল আবার মিশুক। কিন্তু বেশির ভাগই মনের করতেন রাগী। আর আমাদের কিছু খল অভিনেতা রয়েছেন, যাঁরা আমার সম্পর্কে পরিচালক, প্রযোজক, শিল্পীদের কাছে বাজে কথা বলে বেড়ান। এটাই আমাকে পিছিয়ে দিয়েছে। আর আমি কখনোই অভিনয়ের জন্য কারও কাছে যাই না। এটা আমার সঙ্গে যায় না। এটাও হয়তো আমার ক্যারিয়ারকে পিছিয়ে দিয়েছে।’
একে একে সিনেমাগুলো মুক্তি পেতে থাকলে দর্শকের কাছে নানা শাহ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন, যাঁর অভিনয় দেখে দর্শকেরা মারতে চাইতেন। ‘বাজিগর’ মুক্তির পর তেমন একটি ঘটনা ঘটেছিল। একবার ঢাকার বাইরে একটি সিনেমা হল থেকে বের হওয়ার সময় দর্শকেরা তাঁকে ঘিরে ধরেন। ‘প্রেমিক রংবাজ’ সিনেমার শো শেষে দর্শকেরা সবাই তাঁকে মারতে চান। নানা শাহ বলেন, ‘সিনেমার নায়ক ছিলেন রুবেল। তখন রুবেলের তুমুল জনপ্রিয়তা। দর্শক মানতেই পারছিল না বিষয়টা। কেন মারলাম, সে জন্য ঘেরাও করেছিল। এ ছাড়া “বাজিগর” সিনেমার একটি শোতে হেলাল খান, শাবনুরসহ পুরো টিম নারায়ণগঞ্জে একটি হল ভিজিটে গিয়েছিলাম। সিনেমা শেষে দর্শকেরা আমাকে ঘিরে সবার সমানে বলল, “আপনি কেন নায়ক হলেন না।” এসবই আমার প্রাপ্তি, ভক্তদের ভালোবাসা। কিন্তু কখনোই আমার ভক্তদের সঙ্গে ভালো সখ্য ছিল না।’
ছোটবেলা থেকেই অভিনয় পছন্দ করতেন। তাঁর বাবা অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নানা সরফরাস খান ছিলেন বোম্বের অভিনেতা। নানা শাহ বলেন, ‘শৈশবে তাজমহল রোডে প্রথম মঞ্চনাটকে অভিনয় করি। সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপদ নাট্যগোষ্ঠী নামের একটি সংগঠনে অভিনয় শিখতে থাকি। চার বছর পর আবদুল্লাহ আল-মামুনের থিয়েটার দলে কাজ করতে থাকি।’
আবদুল্লাহ আল-মামুন পরিচালিত তথ্যচিত্র ‘মাটি ও মানুষ’-এ প্রথম অভিনয় করেনত তিনি। অভিনয় নিয়ে কতটা খুশি ছিলেন, এমন প্রশ্নে নানা শাহ বলেন, ‘অভিনয় করতাম ভালো লাগত, দর্শক চিনত। বিশেষ করে বলতে গেলে তখন নায়কদের পাশাপাশি আমাদের দেখার জন্যও হাজার হাজার মানুষ জড়ো হতো। কিন্তু এখন তো শাকিব খান ছাড়া আর কারও দিকে ঘুরেও দেখে না দর্শক।’
২০০৫ সাল থেকে অভিনয়ে কিছুটা কম দেখা গেলেও সম্প্রতি ‘বীর’ (২০২০) ‘শাহেনশাহ’ (২০২০) ‘বেপরোয়া’ (২০১৮)–সহ বেশ কিছু সিনেমা দিয়ে নিয়মিত অভিনয় করে যাচ্ছেন। কোনো পরিচালক বা প্রযোজকের প্রয়োজন হলেই তিনি অভিনয় করবেন। তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমি কাউকে বলব না। তবে আমি এখনো অভিনয় করে যেতে চাই।’ দীর্ঘ ক্যারিয়ারে কোনো অভিমান আছে কি না, জানতে চাইলে নানা শাহ বলেন, ‘এফডিসির দুই–তিনজন মানুষ আমার ক্যারিয়ারের ক্ষতি করেছে। এফডিসি বা আমার সহকর্মীরা কেউ বলতে পারবে না, আমি খারাপ। কখনো আমি শিডিউল ফাঁসাইনি, কথার বরখেলাপ করিনি। একটি মেয়েও কখনো বলতে পারবে না, আমি খারাপ। সবাই আমাকে সততার সঙ্গে জীবন যাপন করতে দেখেছেন। ক্যারিয়ারে কোনো কালো দাগ নেই। অনেককে অনুরোধ করব, আমাকে নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়াবেন না।’
কথা শেষে নানা শাহ বলেন, ‘ঠিক যেভাবে এক দিনে তিন ছবির সাইনিং দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল। আমি সব সময় চেয়েছিলাম, এভাবেই আমার ক্যারিয়ার চালিয়ে নেব। আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নেব। কিন্তু নিজের ইন্ডাস্ট্রির মানুষ পেছনে লাগলে, এগুলো কষ্ট।’
বর্তমানে এই অভিনেতা দুই ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে শ্যামলীর বাসায় থাকেন। এই তো কিছুদিন আগে জন্মদিন উদ্যাপন করেছেন তিন। জানালেন, দিনটি পরিবারের সঙ্গেই কাটাতে ভালোবাসেন। এই অভিনেতা জানান, ১৫ নভেম্বর ১৯৫১ সালে তাঁর জন্ম। এখনো তিনি নিয়মিত বাংলা সিনেমা দেখেন।
You must log in to post a comment.