
কলকাতায় শেষ হলো বাংলাদেশ বইমেলা
১০ দিনের মেলা শেষ হওয়ার আগেই বই বিক্রি শেষ। স্বাভাবিক ভাবেই পাঠক বা ক্রেতার চাহিদা মেনে ফের বাংলাদেশ থেকে বই নিয়ে যেতে হয়েছে এবং তাও আবার বেশি পরিবহন খরচ দিয়ে। কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বইমেলা ২০২২-এর বই কেনাবেচার ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেছে।
গত ২ ডিসেম্বর বই পাড়া বলে পরিচিত কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে শুরু হয় বাংলাদেশ বই মেলা। বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রী দীপু মনি ও শিক্ষা মন্ত্রী ব্রাত্য বসুসহ বিশিষ্টজনদের উপস্থিতিতে শুরু হয় এই বইমেলা।কলকাতাস্থ বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন, বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো এবং বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি, ঢাকার উদ্যোগে এই বইমেলার সমাপনী দিবস ছিল রবিবার (১১ ডিসেম্বর)।
সমাপনী দিবসে উপস্থিত ছিলেন আসাদুজ্জামান নূর এমপি, কবি কামাল চৌধুরী, শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার, কলকাতা বইমেলার আয়োজক সংস্থা ‘বুক সেলার্স এন্ড গিল্ডে’র সাধারণ সম্পাদক ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়, কবি কামাল চৌধুরী, বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতির সহ-সভাপতি মাজহারুল ইসলাম, ভাষা ও চেতনা সমিতির সম্পাদক ইমানুল হক, কলকাতায় নিযুক্ত বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনার আন্দালিব ইলিয়াস প্রমুখ।
শেষ দিনে অনেক প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধাররাই বলেছেন, তাদের বই বিক্রির রেকর্ড আগের প্রতিবারের চেয়ে ভালো। এক্ষেত্রে অবশ্য তারা মেলার স্থান নির্বাচনকেই বাহবা দিয়েছেন। তাদের সকলেরই অভিমত কলেজ স্কোয়ার সংলগ্ন এলাকায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, হিন্দু কলেজসহ একাধিক নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বইয়ের দোকান থাকায় পাঠকের সমাবেশ বেশি হয়েছে ফলে বিক্রিও এবার ভালো হয়েছে।
কারো কারো অভিমত- বই বিক্রির পিছনে আরেকটি কারণ গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে এই বইমেলার আয়োজনের ফলে কলকাতায় বাংলাদেশের বইয়ের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে, বাংলাদেশের লেখকদের পরিচিতি বাড়ছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের বইয়ের বাজারও এপার বাংলায় প্রসারিত হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এই বইমেলায় তারই প্রতিফলন ঘটেছে।
আদর্শ প্রকাশনীর খাইরুল ইসলাম পলাশ জানান, অন্য বছরগুলির তুলনায় এবারের বইমেলা খুবই সফলতা লাভ করেছে। বীজগণিত, বিজ্ঞান, ক্যারিয়ার গাইড, চমক আসান সহ বেশকিছু মেলার দ্বিতীয় দিনেই শেষ হয়ে যায়।
একটি পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি জানান, গত মেলায় দশদিনে যেখানে ৫০ হাজার টাকার বই বিক্রি হয়েছে, সেখানে এই মেলায় সমপরিমাণ দিনে পৌনে দুই লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছে। একটা সময় প্রায় অধিকাংশ বইয়ের মজুদ শেষ হয়ে যায়। পরে অনেক বেশি খরচ দিয়ে বাংলাদেশ থেকে নতুন করে বই আনতে হয়েছে।
একই সুর শোনা গেল কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের কর্ণধার নজরুল ইসলামের কাছ থেকেও। এই প্রথম বাংলাদেশ বইমেলা অংশগ্রহণ করেছে এই প্রকাশনী সংস্থা। কিন্তু প্রথমবারই মেলার শেষ হওয়ায় আগেই ৮০ শতাংশ বই বিক্রি হয়ে যায়। স্বভাবতই খুশি এই প্রকাশনা সংস্থার মালিক।
তিনি বলেন, প্রথমবারেই খুব ভালো সাড়া পাওয়া গেছে। আসলে কোনও ধারনাই ছিল না যে এই পরিমাণ বই বিক্রি হতে পারে। পাশাপাশি হাতেও সময় ছিল না যে নতুন করে বাংলাদেশ থেকে বই নিয়ে আসবেন। তবে তাদের আশা যারা এখনো তাদের বই করতে পারেননি তারা আগামী বছর কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় এই বইয়ের সম্ভার পাবেন পাশাপাশি সেই সব গ্রাহকদেরকে এই প্রকাশনার সংস্থার ফোন নাম্বার দিয়ে রাখছেন।
নালন্দা পাবলিশিং হাউজের কর্ণধার রেজওয়ানুর রহমান জুয়েল বলেন, আমাদের বই বিক্রেতা বা প্রকাশকদের কাছে অন্য কলেজ স্কোয়ার অপেক্ষাকৃত ভালো জায়গা। ফলে আগের মেলাগুলির তুলনায় এই মেলায় বই বিক্রির পরিমাণও অপেক্ষাকৃত ভালো।
আহমেদ পাবলিশিং হাউসের কর্ণধার শাহ আলম জানান, মোহর কুঞ্জে বইমেলাতে আমাদের বিক্রি অনেকটাই কম ছিল। কিন্তু এবার তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো হয়েছে। তারও দাবি বারবার মেলা স্থান পরিবর্তন না করে কলেজ স্কোয়ারে পাকাপাকিভাবে এই বইমেলা করা হোক। কারণ এখানকার পরিবেশ ও পাঠক দু’টি খুব ভালো।
আশীষ দাস নামে এক পাঠকের দাবি, মোহরগঞ্জ বা অন্য জায়গার পরিবর্তে কলেজ কেয়ারের মত জায়গা হোক তাতে বই বিক্রি যেমন বাড়বে, তেমনি পাঠকরাও বাংলাদেশ বইয়ের নাগাল পাবে।
বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতির সহ-সভাপতি মাজহারুল ইসলাম জানান, আমরা এতটা আশা করিনি যে কলকাতার পাঠকদের কাছ থেকে এতটা ভালোবাসা পাবো। আমাদের লেখকদের প্রতি, বইয়ের প্রতি ভালোবাসা এটি আমাদের ভালো লেগেছে এবং অন্যান্য বছরের তুলনায় আমাদের বইয়ের বিক্রিও ভালো হয়েছে। আমরা আশা করছি প্রতিবছর এই কলেজ স্কোয়ারে এই বই মেলা করতে চাই।
২০২৩ সালের বাংলাদেশ বইমেলা কলকাতার কলেজ স্কয়ারেই হবে আশ্বাস দিয়ে কলকাতা বইমেলার আয়োজক সংস্থা ‘বুক সেলার্স এন্ড গিল্ডে’র সাধারণ সম্পাদক ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় বলেন, কলেজ স্কোয়ার এশিয়ার বৃহত্তম বই পাড়া। তাই এখানেই বাংলাদেশ বইমেলা হওয়াটাই ভালো।
ত্রিদিব আরও বলেন, কলেজ স্কয়ারের চারপাশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল রয়েছে, ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল জায়গা হলো কলেজ স্কোয়ার। বিদ্যাসাগরের স্মৃতি বিজড়িত, বাংলার নবজাগরণের স্মৃতি বিজড়িত একটি কলেজ স্কোয়ার। এখানে বাংলাদেশ বইমেলা হওয়াতে অত্যন্ত সফল হয়েছে।
আসাদুজ্জামান নূর বলেন, মাঝের দিন গুলির বদলে শেষ দিনে আসতে পেরে আমার নিজেরই দুঃখ লাগছে। আসলে আমরা যতবেশি কথা বলবো, মত বিনিময় হবে, তত বেশি জানতে পারবো, চিনতে পারবো। এই জানাশোনা-বোঝা যত ঘনিষ্ঠ হবে তত সম্পর্ক বন্ধন হবে। দু’টি সরকারের মধ্যে মৈত্রী হয় যেখানে সেখানে টানাপোড়নও থাকে। কিন্তু সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে দিয়ে বা মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে মানুষ-মানুষে যে বন্ধন তৈরি হয় সেই বন্ধনটাই আসল এবং এটিই সকলকে এক করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।
এদিন মেলার শেষ দিনে ঘোষণা করা হয় প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসের প্রথম সোমবার এই মেলার শুরু হবে। সেক্ষেত্রে আগামী বছর ৪ ডিসেম্বর এই বইমেলা শুরু তা চলবে থেকে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ বইমেলার কলকাতা’র যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১১ সালে কলকাতার গগনেন্দ্র সংগ্রহশালায়। পরপর তিন বছর সেখানে অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ২০১৪ সালে এই বই মেলা রবীন্দ্র সদনের উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে স্থানান্তরিত হয়। আর সেই সময় থেকেই মেলায় যোগ হয় নতুন মাত্রা। শুধু বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এটি সাংস্কৃতিক মিলনমেলায় পরিণত হয়। তিন বছর সেখানে এই বইমেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ২০১৭ সালে বইমেলা স্থানান্তরিত করা হয় মোহর কুঞ্জে। এরপর ২০১৯ সাল পর্যন্ত পরপর তিনবার সেখানে এই বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। গত দুই বছর করোনার কারণে এই মেলা আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় চলতি বছরে এই বই মেলার আসর বসে কলকাতার কলেজ স্কোয়ার প্রাঙ্গণে।
You must log in to post a comment.